Safwan Sabit - পড়া বনাম লেখা

পড়া বনাম লেখা

লেখকঃ সাফওয়ান সাবিত

পড়া বনাম লেখা, একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে চিন্তা এবং সৃষ্টি একে অপরকে পরিপূরক করে।

পরিচ্ছেদ ১: পড়ার জগতে প্রবেশ

অর্ণব এক কক্ষে বসে, তার ছোট্ট টেবিলের উপর পুঁথি আর বইয়ের স্তূপ দেখে। ঘরটি ছোট হলেও, তার নিজস্ব জগত—যেখানে বইয়ের পাতাগুলি এক একটি নতুন আবিষ্কারের মতো তাকে টানে। ছোটবেলায় যখন তার সহপাঠীরা খেলা করত, অর্ণব তখন পড়া নিয়ে মগ্ন থাকত। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বাইরেও তাকে প্রায়ই দেখা যেত লাইব্রেরিতে। তার ছোট্ট মনে তখন থেকেই এই ধারণা জন্ম নিয়েছিল যে, বইয়ের মধ্যে অজস্র পৃথিবী লুকিয়ে আছে, যা সে একদিন আবিষ্কার করবে।

প্রথম বইটি ছিল একটি ছোট গল্পের সংকলন। সেখান থেকেই তার পড়ার জগতে প্রবেশ। প্রতিটি গল্পের চরিত্রের সঙ্গে সে যেন নিজেকে মিশিয়ে ফেলত। কখনো সে ছিল সাহসী নায়ক, কখনো মিশন পালনকারী অভিযাত্রী। বইয়ের পাতায় চোখ রেখে সে হারিয়ে যেত এক অজানা দুনিয়ায়, যেখানে তার অস্তিত্বও এক নতুন রূপে রূপান্তরিত হতে থাকত।

পড়ার প্রতি তার আগ্রহ তখন থেকেই বাড়তে থাকে। নতুন নতুন বইয়ের প্রতি তার এক অদ্ভুত টান তৈরি হয়। বই পড়া ছিল তার একমাত্র রুটিন, একমাত্র ভালোবাসা। গোধূলি বেলা যখন বাইরের পৃথিবী কাঁপতে শুরু করত, তখন অর্ণব তার ছোট্ট ঘরে বসে বইয়ের পাতায় চোখ রাখত। আর তখনই সে উপলব্ধি করেছিল, এই বইগুলো তাকে জীবনের অর্থ শেখায়, যে জীবন সে কখনো বুঝতে পারেনি।

বই পড়ার মাধ্যমে, অর্ণব এক অজানা আত্মবিশ্বাস অনুভব করত। মাঝে মাঝে সে ভাবত, বই কি তাকে মানুষ হতে সাহায্য করেছে? না, বই তাকে এক নতুন চোখ দিয়েছে, যেখানে সে মানুষের মনোজগতের গভীরে পৌঁছতে পারে। বই তার একমাত্র বন্ধু ছিল, যে তার ভাবনা ও অনুভূতিকে ধারণ করতে জানত।

এভাবেই, অর্ণব তার পড়াশোনায় নিমগ্ন থাকত, যেখানে পৃথিবী এক জাদুকরি রূপে ফুটে উঠত। সে জানত, বইগুলোই তার জীবনের নতুন দিগন্ত খুলে দেবে, এক নতুন পথ দেখাবে।

পরিচ্ছেদ ২: লেখার প্রবাহ

অর্ণবের জীবনে এক সময় এল যখন সে বুঝতে পারল, বই পড়ার মাধ্যমে যে জ্ঞান ও অনুভূতিগুলি সে অর্জন করত, সেগুলো অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া দরকার। তার মনে হয়েছিল, শুধু পড়াই যথেষ্ট নয়, তার ভাবনা ও চিন্তাভাবনা যদি অন্যদের কাছে পৌঁছায়, তবে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। এভাবে, তার লেখালেখির পথ শুরু হয়েছিল।

প্রথম প্রথম তার লেখা ছিল কেবল অনুভূতির ঝরনা, যা কখনো কখনো জটিল, কখনো সহজ, কখনো আবার অস্থির। প্রথম গল্পটি লিখতে গিয়েই সে বুঝেছিল, লেখা মানে শুধুমাত্র শব্দ দিয়ে কিছু সৃষ্টি করা নয়, বরং নিজের অন্তর্গত অনুভূতিগুলিকে সাজিয়ে, একটি নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করা। প্রতিটি শব্দ যেন এক একটি পিঁপড়ে, যা মিলে একটি শক্তিশালী সংগঠন তৈরি করে।

লেখার কাজ শুরু করার পর অর্ণব মনে করত, লেখালেখি মানে কেবল তার ভাবনা বের করে দেওয়া, কিন্তু আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারে, লেখককে তার পাঠককে ধরতে হবে, তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করতে হবে। তাই তার লেখার শৈলী পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রথমদিকে তার লেখা ছিল আকস্মিক, কাচামাল সৃষ্টির মতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, সে বুঝতে পারল লেখার একটি কৌশল আছে—একটি শৃঙ্খলা, যা তাকে নিজেকে প্রকাশ করতে সাহায্য করে।

অর্ণবের প্রথম ছোট গল্পটি ছিল এক যুবকের জীবন সংগ্রামের কাহিনী। সে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা, তার ভয়ের কথা, আশঙ্কার কথা—সব কিছু তুলে ধরেছিল এই গল্পে। যদিও প্রথম গল্পটি লিখে তার মনে হয়েছিল, অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ, কিন্তু তার মধ্যে এক নতুন শুরুর অনুভূতি ছিল। গল্পটি লেখার পর সে অনুভব করেছিল, তার লেখার মাধ্যমে কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে, একে অপরকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

প্রতিদিন তিনি নতুন কিছু লেখার চেষ্টা করতেন। কখনো কবিতা, কখনো ছোট গল্প, কখনো আবার কিছু চিন্তাভাবনা বা আখ্যান। কিন্তু তার সমস্ত লেখা যেন এক প্রবাহ, যে প্রবাহ তাকে এক নতুন পৃথিবী দেখাচ্ছিল। আর সেই পৃথিবীতে প্রবেশ করার জন্য তাকে কেবল লেখা নয়, নিজেকে লেখার মধ্যে হারিয়ে যেতে হয়েছিল। একদিকে বইয়ের পাতা ও আরেকদিকে তার নিজের সৃষ্টি—এ দুটি পথের মধ্যে পার্থক্য কমে যেতে থাকে।

লেখার মধ্যে সে যেমন নিজের কষ্ট, আশা, নৈরাশ্য প্রকাশ করত, তেমনি অন্যদের অনুভূতিকে সমঝে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে চেয়েছিল। আর যখন তার লেখা কেউ পড়ত, তখন সে অনুভব করত, তার কষ্ট যেন কিছুটা লাঘব হয়েছে। লেখা তাকে শান্তি দিত, সে যেন নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বের সাথে একটি সমঝোতা করতে পারত।

এইভাবে, অর্ণবের লেখালেখি শুরু হয়। শুরুতে ছিল একটুকু দ্বিধা, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে তার লেখার প্রতি নিবেদিত হয়ে পড়ে।

পরিচ্ছেদ ৩: পড়া ও লেখার সম্পর্ক

পড়া এবং লেখা, এই দুটি কার্যক্রম যেন একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। অর্ণব নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে একথা বুঝতে পারল। পড়া তাকে নতুন দৃষ্টি দিয়েছিল, আর লেখা সেই দৃষ্টি থেকে পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখার উপায়। কখনো সে ভাবত, যদি বই না পড়ত, তবে হয়তো লেখার প্রতি তার আগ্রহ জন্মাত না। বইগুলোই ছিল তার সবচেয়ে বড় শিক্ষক, যারা তার ভাবনাকে জাগিয়ে তুলত, তার কল্পনাকে উড়ান দিত।

পড়ার সময় তার মনে এক ধরনের অনুপ্রেরণা জাগ্রত হত, যা তাকে লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করত। সে বুঝতে পারল, একজন লেখক হয়ে ওঠার জন্য শুধুমাত্র নিজের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট নয়; পৃথিবী সম্পর্কে, মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে, তাদের অনুভূতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই জ্ঞান তার আসতো পড়ার মাধ্যমে। তাই বই পড়া এবং লেখা—এই দুটি একে অপরকে পরিপূরক করে চলছিল।

অর্ণব লক্ষ্য করল, যখন সে পড়তে শুরু করত, তখন তার মনে নতুন নতুন চিন্তাভাবনা উদয় হতো। সে এমন এক জগতে প্রবেশ করত, যেখানে লেখকরা তাদের অভ্যন্তরীণ পৃথিবী, যন্ত্রণাগুলো, আশা-নিরাশা, ভালবাসা-অভিমান—সব কিছুই তুলে ধরতেন। সে ভাবত, তারা কেন লেখেন? কেন তাদের জীবনের গল্পগুলো অন্যদের কাছে পৌঁছানো জরুরি মনে হয়? আর তখনই সে বুঝতে পারল, লেখালেখি শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়, মানুষের অনুভূতিকে সঠিকভাবে প্রকাশ করারও একটি মাধ্যম।

এবং সেখানেই তার পড়া এবং লেখার সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়ে উঠল। সে লক্ষ্য করল, যখন সে কোন গল্প বা কবিতা পড়ত, তখন সে নিজেকে চরিত্রগুলোর মধ্যে খুঁজে পেত। সেই অনুভূতিগুলো যেন তার নিজের জীবনের সাথে মিশে যেত। বইয়ের পাতা থেকে যে পাঠ সে অর্জন করত, তা কখনো একেবারে নতুন ভাবনা নিয়ে আসত, কখনো পুরনো চিন্তাধারায় রঙ যোগ করত। এবং তখনই তার লেখা তৈরি হতো, যে লেখা তার অন্তর্গত ভাবনা এবং অনুভূতিকে সজীব করে তুলত।

একদিন, যখন অর্ণব তার একটি গল্প লিখছিল, সে অনুভব করল যে, তার লেখা কেবল তার ভাবনাকে নয়, পুরো পৃথিবীকে তুলে ধরছে। সে জানত, পড়ার মধ্য দিয়ে সে যা শিখেছে, তা লেখার মধ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। বইয়ের পাতায় পড়া শব্দগুলো যখন তার নিজের লেখায় রূপ নেয়, তখন তার কল্পনা এক নতুন বাস্তবে জন্ম নেয়।

তার লেখার মধ্যে যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছিল, তা পড়ার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল। আর এই সম্পর্কটি কখনোই আলাদা হতে পারে না—পড়া এবং লেখা একে অপরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, যেন দুই নদী যে একসঙ্গে মিশে একটি মহাসমুদ্রে পরিণত হয়।

অর্ণবের মনে পড়েছিল এক পুরনো উক্তি: “একজন ভালো লেখক হতে হলে, ভালো পাঠক হতে হয়।” এই উক্তির গুরুত্ব সে বুঝতে পারল। যদি সে পড়তে না জানত, তবে তার লেখার মধ্যে সেই গভীরতা, সেই জীবন্ততা আসতো না। পড়ার মাধ্যমে যা সে শিখত, তা লেখার মাধ্যমে বিশ্বকে জানাতে পারত—এটাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য।

এভাবে, অর্ণবের পাঠ এবং লেখার সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হতে থাকে। বইয়ের পাতায় হারিয়ে গিয়ে, লেখার মাধ্যমে তিনি পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করেন।

পরিচ্ছেদ ৪: জীবনের পথে পড়া এবং লেখা

অর্ণবের জীবনে এক সময় এল যখন তার দুই পথ—পড়া এবং লেখা—একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিল। সে বুঝতে পারল, শুধু পড়া আর লেখা একে অপরকে পরিপূরক করলেও, এক সময় এসবই তাকে তার জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করতে বাধ্য করবে। সে তখন বুঝতে পারল যে, পড়া এবং লেখা কেবল শখ বা অভ্যাস নয়, বরং জীবনযাত্রার এক অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একদিন, অর্ণব তার জীবনের অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়ে ভেবে দেখল। পড়া এবং লেখা তাকে কোথায় নিয়ে গেছে? বইগুলো তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, জীবনের নানা দিক দেখিয়েছে, কিন্তু নিজের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণাগুলো, তার নিজের সংকটগুলোর সমাধান সে কোথা থেকে পাবে? লেখার মাধ্যমে তার কল্পনাকে এক্সপ্রেস করা সম্ভব হলেও, প্রকৃত জীবনের সমস্যাগুলোর মোকাবিলা কীভাবে করবে সে? পড়া তাকে যতটা জ্ঞান দিয়েছে, লেখাও তাকে ততটাই আত্মবিশ্বাস ও শক্তি দিয়েছে, কিন্তু জীবনকে বাস্তবে পরিচালনা করা কি এত সহজ?

এ মুহূর্তে, তার জীবনে পড়া এবং লেখা একের পর এক প্রশ্ন উত্থাপন করছিল, তার চিন্তাভাবনাকে আরও গভীর করে তুলছিল। অর্ণবের মনে পড়ছিল ছোটবেলার কথা, যখন বই তাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছিল, আর লেখা তার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার জন্য এক উত্তরণের পথ ছিল। কিন্তু জীবনের পথ এতটা সরল ছিল না। কখনো কখনো, তার মনে হত, লেখার মাধ্যমে যে সে আত্মপ্রকাশ করত, তা সবসময়ই মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বের উপশমে পরিণত হতে পারত না। লেখার মাধ্যমে তিনি যদি অন্যদের অনুভূতি বুঝতে পারতেন, তবে নিজের অনুভূতিগুলো কীভাবে আরও ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারতেন?

পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ কখনোই কমেনি, কিন্তু জীবনকে দেখার ও বুঝতে পারার ব্যাপারটা আরো গভীর হয়ে উঠছিল। এখন তার লক্ষ্য ছিল শুধু লেখার মাধ্যমে অনুভূতি প্রকাশ করা নয়, বরং জীবনকে ভালোভাবে দেখার, তার সংকটগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার এবং সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা। সে জানত, লেখার মধ্যে মানুষের জীবনের বাস্তবতা থাকতে হবে, এবং সে যা লিখবে, তা যেন মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।

অর্ণব বুঝতে পারল, তার পড়াশোনার প্রভাব শুধু তার মনোজগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এই জ্ঞান তাকে তার নিজস্ব সংকটগুলো মোকাবিলা করতে সহায়তা করতে পারে। লেখার মাধ্যমে যখন সে অন্যদের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম বা যন্ত্রণার কথা তুলে ধরত, তখন তার নিজের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধও কিছুটা শান্ত হত। তাই সে প্রতিদিন লেখার মধ্যে নিজেকে অনুসন্ধান করত, নিজের চিন্তাভাবনাকে বিশ্লেষণ করত। সে যে লেখালেখি করত, তা কেবল নিজের জন্য নয়, পৃথিবীকে তার নিজের চোখে দেখা ও বোঝার জন্য ছিল।

এ সময় অর্ণবের জীবনে একটি বড় পরিবর্তন আসল। বই ও লেখার মধ্যে সে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পেল, যা তাকে তার নিজস্ব জীবনকে নতুনভাবে দেখতে সাহায্য করেছিল। পড়া এবং লেখা একে অপরের মধ্যে ঢুকে পড়ে তার অস্তিত্বের অংশ হয়ে উঠেছিল। সে বুঝতে পারল, যখন সে অন্যদের অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করত, তখন সে নিজেকে আরও বেশি অনুধাবন করতে পারত, এবং সে যেভাবে লিখত, তা তার অভ্যন্তরীণ আত্মবিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করে তুলত।

এভাবে, অর্ণবের জীবন পথ চলতে চলতে পড়া ও লেখা এক নতুন অবস্থানে পৌঁছেছিল, যেখানে জীবনের সবচেয়ে গভীর প্রশ্নগুলো এবং উত্তরগুলো তার মনের মধ্যে এক স্থিতিশীল জায়গা পেয়েছিল।

পরিচ্ছেদ ৫: শেষ কথন: লেখা এবং পড়ার চিরকালীন সম্পর্ক

অর্ণব আজ বুঝতে পারল, পড়া এবং লেখা এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, যা তাকে শুধুমাত্র নিজের জীবনের মধ্যে নয়, বরং পৃথিবীকে দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। কখনো সে ভাবত, যদি পড়াশোনা না করত, তবে হয়তো তার লেখালেখি শুরুই হত না। বইগুলো তাকে কেবল জ্ঞান দেয়নি, দিয়েছে জীবনের গভীরতা এবং তার নিজের অনুভূতিগুলিকে অঙ্গভঙ্গি দিয়েছিল—যে অনুভূতিগুলি একসময় কেবল তার মনেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা অক্ষরের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পৌঁছে যাচ্ছিল। আর লেখাও তাকে নিজের অস্তিত্বকে বুঝতে সাহায্য করেছে, এক ধরনের আত্মঅন্বেষণ করেছে।

পড়া এবং লেখা, দুইটি প্রক্রিয়া একে অপরকে শক্তি দিয়েছে। লেখক হতে হলে তাকে ভালো পাঠক হতে হবে—এই ধারণাটি অর্ণব সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছিল। পড়ার মাধ্যমে তার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি সঞ্চিত হত, আর লেখা তার সেই অভিজ্ঞতাগুলিকে জীবন্ত করে তুলত। একদিকে, বই তাকে নতুন দৃষ্টি দিয়েছিল, অন্যদিকে লেখা তার হৃদয়ের গভীরতাকে প্রকাশ করত।

আজ অর্ণব জানে, লেখার প্রতিটি অক্ষরে সে নিজের আত্মাকে তুলে ধরছে, আর সেই প্রতিটি অক্ষর নিজেই একেকটি অভিজ্ঞতা, একেকটি নতুন দুনিয়ার সৃজন করছে। এই পৃথিবীতে যেখানে একেকজনের জীবনের সংগ্রাম আলাদা, সেখানে লেখা এমন এক সেতু তৈরি করতে পারে, যা মানুষকে একত্রিত করে, তাদের মনকে স্পর্শ করে, তাদের অন্তর্গত যন্ত্রণা, সুখ এবং সমাধানকে একে অপরের মাঝে খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

অর্ণব এখন জানে, পড়া এবং লেখা শুধুমাত্র একে অপরকে সমর্থন করে না, বরং তারা একে অপরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে মানুষের অন্তর্গত সত্যের অনুসন্ধান করে। পড়া তাকে পৃথিবী এবং মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছে, আর লেখা তাকে সেই জ্ঞানের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা দিয়েছে।

বই পড়ার সময়, অর্ণব কখনো ভাবত, লেখক কেন তার গল্পটি লিখেছেন, কীভাবে তার চিন্তা-ভাবনা তাকে এতটা প্রভাবিত করেছে। আর আজ, নিজে লেখক হয়ে সে উপলব্ধি করল—লেখা কেবল নিজের গল্প বলার জন্য নয়, বরং অন্যদের জীবনকে আলোকিত করার একটি উপায়ও হতে পারে। বইগুলো তাকে পথ দেখিয়েছে, আর লেখা সেই পথে অর্ণবকে চলতে সাহায্য করেছে।

অর্ণবের জীবনের এই যাত্রা শেষ হয়নি, কারণ পড়া এবং লেখা চিরকাল চলতে থাকে। বইয়ের পাতায় নতুন কিছু পড়া, নতুন কিছু শিখা, এবং সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে নিজের লেখায় রূপ দেওয়া—এটাই তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে জানে, লেখার মধ্যে যে শক্তি রয়েছে, তা পৃথিবীকে নতুন করে দেখার ক্ষমতা রাখে, আর পড়ার মধ্যে যে রহস্য রয়েছে, তা মানুষের আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে।

এভাবেই, পড়া এবং লেখা—এই দুটি অঙ্গীকার এক চিরকালীন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যা কখনো শেষ হবে না। পৃথিবীটা যত বড়, অর্ণবের লেখাও ততই বিস্তৃত হবে। জীবনের প্রতি তার ভালোবাসা এবং উপলব্ধি, তার লেখার মধ্যে অমর হয়ে থাকবে।

(সমাপ্ত)